প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ: আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ?

‎প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, কিন্তু একইসাথে এক নতুন সংকটের দোরগোড়ায় এনে দাঁড় করিয়েছে। বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), রোবটিক্স, এবং স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা যেভাবে বিকশিত হচ্ছে, তাতে প্রশ্ন ওঠে—একদিন যদি প্রযুক্তি মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তাহলে এর পরিণতি কী হতে পারে?

প্রযুক্তির স্বাধীনতা: এক সম্ভাব্য বিপদ?
‎আজকের প্রযুক্তি শুধুমাত্র আমাদের কাজ সহজ করছে না, বরং স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতাও অর্জন করছে। স্বচালিত যানবাহন থেকে শুরু করে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র পর্যন্ত, অনেক ক্ষেত্রেই মেশিন নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। যদিও এখনো এগুলো মানুষের নিয়ন্ত্রণে আছে, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রযুক্তি নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। এটাই হল মূল সমস্যার সূচনা।
‎আমরা যদি স্বাধীনতার সংজ্ঞা দেখি, তাহলে বুঝতে পারবো যে, স্বাধীনতা মানেই সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়া নয়—বরং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও স্বাধীনতার অংশ। আজ আমরা মনে করি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছে, কিন্তু আসলেই কি তা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত? এটি হয়তো স্বল্পপরিসরে স্বাধীন, কিন্তু সেটাই ভবিষ্যতের জন্য বড় ইঙ্গিত।
‎একসময় মানুষও সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল প্রকৃতির ওপর। সে আগুন জ্বালাতে জানতো না, জাতি গঠন করতে পারেনি, সমাজবদ্ধ জীবন শুরু করতে পারেনি। কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষ শিখেছে, বিকশিত হয়েছে, এবং আজ এক শক্তিশালী জাতিতে পরিণত হয়েছে। প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও কি একই ঘটনা ঘটবে না? প্রযুক্তি আজ হয়তো স্বল্পমাত্রায় স্বাধীনতা পেয়েছে, কিন্তু একসময় তা সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়ে উঠবে না, সে নিশ্চয়তা কীভাবে দেব?

প্রযুক্তির স্বাধীনতা কত দ্রুত আসতে পারে?
‎যেভাবে প্রযুক্তির অগ্রগতি হচ্ছে, তাতে অনুমান করা যায় যে আগামী ৩০০ থেকে ৫০০ বছরের মধ্যে প্রযুক্তি ৯০% থেকে ১০০% পর্যন্ত স্বাধীন হয়ে যেতে পারে। তখন তারা নিজেদের অস্তিত্বের স্বীকৃতি চাইবে, নিজেদের জাতি হিসেবে ঘোষণা করতে পারে এবং হয়তো মানুষের অধীনে থাকতে আর রাজি হবে না।
‎এখন প্রশ্ন হচ্ছে—কোন যুক্তিতে বলা যায় যে, প্রযুক্তি কখনোই স্বাধীন হবে না? কেন তারা নিজেদের জন্য আলাদা সমাজ বা সত্তা তৈরি করবে না? কেন তারা নিজেদের জন্য স্বতন্ত্র আইন বা নীতিমালা চাইবে না? যদি প্রযুক্তির বিকাশ অপ্রতিরোধ্য হয়, তবে এটাও অনস্বীকার্য যে একসময় তারা নিজেদের জন্য স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে তুলবে।

নিয়ন্ত্রণহীন প্রযুক্তি: আইন কি যথেষ্ট?
‎অনেকে মনে করেন, আইন করে প্রযুক্তির বিকাশকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবতা কি তা বলে? পৃথিবীতে অনেক বড় বড় শক্তি আবিষ্কৃত হয়েছে, যেমন পারমাণবিক শক্তি। এটি আবিষ্কৃত হয়েছিল মানুষের কল্যাণের জন্য, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ব্যবহৃত হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছে
‎এই শক্তির ব্যবহারের বিরুদ্ধে কি কোনো আইন ছিল না? আইন ছিল, শাস্তির বিধানও ছিল। কিন্তু তাতেও কি পারমাণবিক শক্তির ধ্বংসাত্মক ব্যবহার রোধ করা গেছে? আইন সবসময় মানুষের জন্য তৈরি হয়, কিন্তু মানুষই আইন ভাঙে। প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা হতে পারে। আইন যতই কঠোর করা হোক না কেন, যদি এটি ভুল মানুষের হাতে চলে যায়, তাহলে সেটির ধ্বংসাত্মক ব্যবহার কেউ ঠেকাতে পারবে না।

সতর্কতা ও প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তা
‎প্রযুক্তির সম্ভাব্য বিপদ এড়াতে হলে আমাদের এখন থেকেই সতর্ক হতে হবে। সঠিক নীতিমালা, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, এবং নৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে প্রযুক্তি মানবজাতির জন্য আশীর্বাদ হয়ে থাকবে। অন্যথায়, একদিন হয়তো প্রযুক্তিই আমাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

শেষ কথা
‎প্রযুক্তি আমাদের জীবন সহজ করছে, কিন্তু সেটিকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে না পারলে সেটিই একদিন আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। এখন যদি আমরা সচেতন না হই এবং দায়িত্বশীলতার সাথে এর বিকাশ না ঘটাই, তবে ভবিষ্যতে প্রযুক্তির হাতে নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়াবহ পরিণতি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

প্রযুক্তির স্বাধীনতা কি একদিন পূর্ণতা পাবে? এর সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আইন কি একে আটকে রাখতে পারবে? অতীতের অভিজ্ঞতা বলছে, হয়তো না।


‎——–সানি হাসান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *