
নিউ ঢাকা টাইমস : ডেক্স রিপোর্ট
বাংলাদেশে সংঘটিত গুমের অধিকাংশ ঘটনায় পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি) এবং কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) এর জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এমন অভিযোগ উঠে এসেছে গুম নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী রিপোর্টে।
প্রতিবেদন অনুসারে, যারা গুমের শিকার হয়েছেন, তাদের স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা অধিকাংশ সময়েই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকেই দায়ী করেছেন। এ ছাড়া তদন্তে উঠে এসেছে, পুলিশের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা ইউনিট যেমন ডিজিএফআই, এনএসআই ও বিজিবির সদস্যদের বিরুদ্ধেও গুমের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
কমিশনের মতে, ডিজিএফআই ও এনএসআই মূলত গোয়েন্দা নজরদারির কাজে নিয়োজিত থাকলেও, তারা সংবিধান লঙ্ঘন করে বেআইনিভাবে মানুষকে আটক, অপহরণ ও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এতে আইনব্যবস্থার বাইরে একটি শক্তিধর অবৈধ কাঠামো গড়ে উঠেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
রিপোর্টে আরো বলা হয়, বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও গোয়েন্দা বাহিনীগুলো অনেক সময় নিজ এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে অভিযান চালিয়েছে। ফলে এসব কার্যক্রম নিয়মনীতি (এসওপি) ভেঙে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
পুলিশ বাহিনীর অন্ধকার অধ্যায়
পুলিশের বিশেষ ইউনিটগুলোর মধ্যে রয়েছে ডিবি, এসবি, সিআইডি ও র্যাব। ২০০৯ সালের পর থেকে পুলিশকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার শুরু হয়। সে সময় বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতনের প্রবণতা বাড়ে, যা দেশের ভেতর ও বাইরে উদ্বেগের কারণ হয়।
‘ক্রসফায়ার’ নামে পরিচিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়, যেখানে কোনো রকম বিচার ছাড়াই হত্যা চালানো হতো। অনেকেই হেফাজতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন – যার মধ্যে মারধর, ইলেকট্রিক শক, পানিতে চুবানো ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।
২০১৩ সালে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু প্রতিরোধ আইন পাস হলেও, তা বাস্তবে কার্যকর হয়নি। অল্প কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই এই আইনের আওতায় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ছাত্র আন্দোলন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ – এসব ক্ষেত্রেও পুলিশ শক্ত হাতে দমননীতি গ্রহণ করে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ‘জুলাই অভ্যুত্থান’-এর সময় পুলিশের ভূমিকাও ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।
বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করে ভিন্নমতের মানুষদের গ্রেপ্তার করা হয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা প্রচারণার মতো অস্পষ্ট অভিযোগে অনেককে আটক করা হয়েছে।
কমিশনের বক্তব্য অনুযায়ী, বহু রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, শিক্ষক, ছাত্র, ব্যবসায়ী এবং সমালোচক গুমের শিকার হন, যাদের অনেককে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে।
র্যাবের রূপান্তর: দমনযন্ত্রের চেহারা
র্যাব শুরুতে অপরাধ দমন বাহিনী হিসেবে প্রশংসা পেলেও অল্প সময়েই মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য আন্তর্জাতিক মহলে নিন্দিত হতে শুরু করে।
তদন্ত কমিশন অসংখ্য অভিযোগ পেয়েছে, যেখানে র্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে গুম, হেফাজতে নির্যাতন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কথা বলা হয়েছে।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে দেখা গেছে, র্যাবের হাতে আটক হওয়া অনেক ব্যক্তিকে পরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে বা আজও নিখোঁজ রয়েছেন। এতে বাহিনীটির প্রতি আইনের শাসন ও মানবাধিকারের সম্মান নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
র্যাব গঠনের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এ বাহিনীকে সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় সমর্থন দিলেও, তা পরবর্তীতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের ‘ডেথ স্কোয়াড’-এ পরিণত হয়।
র্যাব কার্যক্রমে স্বাধীনতা পেলেও, তদারকির অভাব থাকায় সদস্যদের অনেকেই অপব্যবহার করেছে। গোয়েন্দা শাখাগুলো ব্যাটালিয়নগুলোর সঙ্গে গোপনে অপারেশন চালাতো, যেখানে সন্ত্রাস, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের নামে বহু অপহরণ ও গোপন আটকের ঘটনা ঘটে।
টিএফআই সেলে বহু মানুষকে দিনের পর দিন কিংবা মাসের পর মাস অন্ধকার ঘরে চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় আটকে রাখা হতো।