বিশ্ব বাণিজ্য সংকট: আমেরিকার শুল্ক নীতির ঝুঁকি ও বৈশ্বিক উত্তেজনার সম্ভাবনা

বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতি এক জটিল ও আন্তঃনির্ভরশীল পর্যায়ে রয়েছে। বিশেষ করে আমেরিকার শুল্ক আরোপ নীতি বিশ্ব বাণিজ্যের সংকট তৈরি করছে, যা শুধু আমেরিকার নয়, সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে।

‎আমেরিকার শুল্ক আরোপ ক্ষতি ও সীমাবদ্ধতা:-
‎আমেরিকা শুল্ক আরোপের মাধ্যমে নিজেদের বাজার রক্ষা করার চেষ্টা করছে। চীন, ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাণিজ্য দ্বন্দ্ব শুরু হলেও বর্তমানে এই নীতি মূূলত ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের বাজারে প্রবেশ এবং বিশেষ করে ডেইরি মার্কেটে মার্কিন পণ্য ঠেলতে চাইছে, যা ভারতের জন্য চাপের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের ডেইরি মার্কেটের আকার ৪৫ বিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বের ২০%। কিন্তু ভারত এ ক্ষেত্রে ছাড় দিতে নারাজ। ট্র্যারিফ বাড়ানোর পরপরই ভারত ৭ বিলিয়ন ডলারের ক্রয় আদেশ স্থগিত করেছে।

‎ইউএসের সাথে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি ৪৫ বিলিয়ন ডলার হলেও এটি ৮০০ বিলিয়ন ডলারের মোট ঘাটতির তুলনায় ছোট। ভারত আগেও ইউএস ছাড়া চলেছে, এখনো সামান্যতম নির্ভরশীল নয়। ইউএসের প্রতিশ্রুতির মান ও আচরণের কারণে ভারত ধীরে ধীরে এই সম্পর্ক থেকে সরে আসছে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের নিম্নমানের পণ্য কিনতে আগ্রহী নয়, যা ইউএসকে উদ্বিগ্ন করছে। বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান দ্বন্দ্ব শুধু ভারতের সাথে সীমাবদ্ধ নয়—ভবিষ্যতে আমেরিকা চীনের সাথেও এমন শুল্ক নীতি নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়াতে পারে।

‎মধ্যপ্রাচ্য, আরব আমিরাত ও আফ্রিকা:-
‎ভারত ও চীনের গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প বাজার
‎ইউরোপ ও আমেরিকার বাজার হারালেও মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, আফ্রিকা এবং আরব আমিরাত এখন ভারত ও চীনের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প বাজারে পরিণত হয়েছে। আরব আমিরাতের ভৌগোলিক অবস্থান এশিয়া ও আফ্রিকার সংযোগস্থল হওয়ায় বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। আফ্রিকার অধিকাংশ দেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নশীল ও নিম্ন আয়ের হওয়ায় সেখানে সস্তা পণ্যের চাহিদা অনেক বেশি, যা ভারত ও চীন সফলভাবে পূরণ করছে।

‎মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা থাকলেও, এই অঞ্চল এবং আফ্রিকার বাজার দীর্ঘমেয়াদে ভারত ও চীনের জন্য বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করছে। ভারত চাইলে রাশিয়া থেকে আরও বেশি তেল কিনে ইউএসের শুল্ক নীতির কারণে হওয়া ক্ষতি সহজেই পুষিয়ে নিতে পারবে। ট্রাম্পের পদক্ষেপ ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মাত্র ০.০২% কমাতে পারে, যা খুবই নগণ্য।

‎শক্তিশালী জোট, ভারত, রাশিয়া ও চীনের সম্ভাবনা:-
‎আমেরিকার ধারাবাহিক শুল্ক নীতি এবং সম্ভাব্য নতুন বাণিজ্য যুদ্ধের জবাবে বিকল্প হতে পারে শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোট। ভারত, রাশিয়া এবং চীন যদি একত্রে একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জোট গঠন করে, তাহলে বিশ্ব অর্থনীতির ভারসাম্য বদলে যেতে পারে। তারা নিজেদের মধ্যে বিশাল বাণিজ্যিক বাজার তৈরি করতে পারে এবং নতুন একটি মুদ্রা চালু করতে পারে, যা ডলারের আধিপত্য কমিয়ে দেবে। এতে ইউএসের অর্থনৈতিক প্রভাব হ্রাস পাবে এবং বিশ্বরাজনীতিতেও পরিবর্তন আসবে।

‎ভারত যদি গুগল, ইউটিউব ও ফেসবুকের বিকল্প তৈরি করে, তাহলে ইউএস বড় ধরনের ধাক্কা খাবে, কারণ ভারতের বিপুল মানবসম্পদই তার মূল শক্তি। এদিকে, এপলের মতো কোম্পানি যদি ভারতের বাজার এড়িয়ে চলে, তাহলে তাদের টিকে থাকা কঠিন হবে। ইউএস ইতোমধ্যেই কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়েছে, কারণ বহু দেশ ব্রাজিল ও অন্যান্য উৎস থেকে সস্তা ও উচ্চমানের পণ্য কিনছে, যেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নও মার্কিন পণ্যকে মানের কারণে প্রত্যাখ্যান করছে।

‎শুল্ক আরোপের রাজনৈতিক ও সামরিক ঝুঁকি:-
‎শুল্ক আরোপ শুধুমাত্র অর্থনৈতিক অস্ত্র নয় এটি রাজনৈতিক উত্তেজনারও কারণ হতে পারে। ইতিহাসে দেখা গেছে, কোনো শক্তিধর দেশের অর্থনৈতিক আধিপত্য হ্রাস পেলে তারা সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে। যদি ইউএস তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বজায় রাখতে গিয়ে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে, তাহলে বিশ্বমঞ্চে বৃহৎ সংঘর্ষের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এই সংঘাতের পেছনে ব্যক্তি নেতৃত্ব নয়, বরং ‘ডিপ স্টেট’-এর ভূমিকা থাকতে পারে, অর্থাৎ ট্রাম্প বা বাইডেন—যেই থাকুক, নীতির মূল স্রোত একই থাকবে।

‎উপসংহার:-
‎বিশ্ব অর্থনীতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। আমেরিকার শুল্ক আরোপ নীতি সাময়িক ধাক্কা হতে পারে, কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিশ্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি তৈরি করতে পারে। ভারত, রাশিয়া, চীন ও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলো যদি একত্রিত হয়ে শক্তিশালী জোট গঠন করে, তাহলে বিশ্ব বাণিজ্যের নতুন অধ্যায় শুরু হবে এবং আমেরিকার প্রভাব অনেকটাই কমে আসবে। বিশ্বকে শান্তিপূর্ণ ও সুষম বাণিজ্য ব্যবস্থার দিকে এগোতে হবে, নয়তো নতুন ধরনের বৈশ্বিক সংঘাতের ঝুঁকি থেকে যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *